মোল্লা তানিয়া ইসলাম তমা:::- বুক ভরা দুঃখ কষ্ট ও শত ভয়ের মাঝেও উঠানে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে বিচার চাই, বিচার চাই বলে শ্লোগান দিলাম, পিছন থেকে আওয়াজ আসলো ধর্ষকদের বিচার চাই ।
পিছনে ফিরে দেখি আমার বাবা ও মা তারাই আসলে শ্লোগান ধরেছে, ধর্ষকদের বিচার চাই বলে । তখন আমার বাবা ও মার চোখের জ্বল ছলছল করছিল । ঐ মুহূর্তে বাবা তার পকেট থেকে কলম বের করে আমার হাতে দেয় এবং আমার মা দৌড়ে গিয়ে একটি খাতা এনে দিয়ে বলে এই বিষয়ে তুই কিছু লিখ ।
আমি এক ক্ষুদ্র কলম সৈনিক, তাই বীরের মত আজকের এই লেখা ( ভুল হলে ক্ষমা করবেন ) । ধর্ষণের একেকটি ঘটনা ঘটার পর দেশজুড়ে তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়, বিভিন্ন শ্লোগানে মিছিল, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশের মানুষ । ধর্ষণের শিকার তনু-মিতু-নুসরাতের নাম মানুষের মুখে মুখে ও অন্তরে ।
নামগুলো যেন দেশের সব ধর্ষিতার এক বিরল প্রতীক । বিচারের দাবিতে সোচ্চার জনতার কণ্ঠ স্তিমিত হতে না হতেই আবারও নতুন করে আরেকটি ধর্ষণের খবর আসে । যুক্ত হয় ধর্ষিত-নিপীড়িত-নির্যাতিত নতুন নতুন নাম । এই চক্রেই আটকে যায় দেশ । এ পরিস্থিতির মধ্যেই রবিবার রাজধানীর কুর্মিটোলায় ধর্ষিত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী । বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার সময় রবিবার সন্ধ্যায় ধর্ষণের শিকার হন দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রী ।
বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কাছে গলফ ক্লাব সীমানার শেষ প্রান্তে ঝোপের মধ্যে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ঝোপের মধ্যে মেয়েটির ইনহেলার, ক্লাসের নোটবুক, লেকচার শিট, চাবির রিং পড়েছিল । সেখান থেকে জুতা ও কালো রঙের একটি জিনসও পাওয়া গেছে । প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, ধর্ষক একজন। ইতিমধ্যে এই ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা দায়ের করেছেন ঢাবির ওই ছাত্রীর বাবা ।
ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সোমবার দিনভর ক্যাম্পাস জুড়ে বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন হয়েছে এবং শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা । শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও ।
ধর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রায় সব ছাত্র সংগঠনই রবিবার রাতেই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে । সোমবার অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঘটনাস্থলের সামনেও সড়ক অবরোধ করে অবস্থান ধর্মঘট করেছে শিক্ষার্থীরা । রোববার গভীর রাতে ওই ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ধর্ষণের সময় ওই ছাত্রীকে মারধরও করা হয়েছে। ধর্ষণ ও মারধরের কারণে মেয়েটি অচেতন হয়ে পড়েছিল।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান সড়কের ফুটপাতের পাশে গলফ ক্লাবের সীমানাঘেঁষা গাছপালাঘেরা স্থানটিতে এর আগেও একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নেমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী যদি সন্ধ্যাবেলায় এভাবে ধর্ষিত হন তাহলে রাজধানীর পথেঘাটে নারীর নিরাপত্তা কতটুকু? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় তোলা এ ঘটনার দ্রুতবিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সচেতন নাগরিকরা।
মানবাধিকার ও নারীআন্দোলন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, বিচার না হওয়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ধর্ষণ বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা বরং দেশে ধর্ষণ দিন দিন বাড়ছেই।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আসকের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ নারী।
একইসঙ্গে নারীদের উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানির ঘটনাও বেড়েছে। ২০১৯ সালে উত্ত্যক্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৮ নারী। আরও উদ্বেগজনক যে, শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাও বেড়েছে। ২০১৯-এ শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ ও নিখোঁজের পর মোট ৪৮৭ শিশু নিহত হয়েছে। আগের বছর নিহত হয় ৪১৯ শিশু।
বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম। বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষের এক কেইসস্টাডি থেকে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা, ঝিনাইদহ, জামালপুর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৩৭২টি ।
কিন্তু এসব মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ৫ জনের । পুরো দেশে এমন লাখ লাখ মামলা নিষ্পত্তিহীন রয়ে গেছে । গত বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলাগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয় । কিন্তু ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করাসহ ওই সাত দফা নির্দেশনাতেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি ।
দেশে সামগ্রিকভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মেয়েদের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান হলেও অগ্রগতির এই চিত্রকে ম্লান করে দিচ্ছে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যার বর্বরতা। তবে, হতাশার মধ্যেও আশাব্যঞ্জক খবর হচ্ছে, সামাজিক পরিসরে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পাশাপাশি নির্যাতন প্রতিরোধের ঘটনাও বাড়ছে।
সম্প্রতি নুসরাত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। এ পথ ধরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করা হবে সেটাই প্রত্যাশা। খুন- গুম, ধর্ষণ- নির্যাতন; নিপীড়ন- বর্বরতার বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ।
আইনের শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শতভাগ সহায়তা করতে হবে । সকল কে সচেতন হতে হবে । তাহলে হয়তো বা আমাদের বিচার চাই, বিচার চাই বলে এত শ্লোগান দিতে হবেনা ।
Leave a Reply