আব্দুর রহিম হাওলাদার (রাজু):: – রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর পাটোয়ারীর বাড়িতে শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে আয়োজিত তাফসিরুল কোরআন মাহফিলে মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারীর কাছে হিন্দু পরিচয়ে কালেমা পাঠ করে মুসলমান হন একই পরিবারের ১১জন। কিন্তু অভিযোগ ওঠে তারা আগে থেকেই মুসলিম ছিলেন, মাহফিলে কেবলমাত্র পরিচয় গোপন করে হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়ার নাকট মঞ্চায়ন করা হয়েছে।
পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের পূর্ব থেকে মুসলিম পরিচয়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। শনিবার এ ঘটনা রামগঞ্জে ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হয়। এ ঘটনায় ওই পরিবারের সবাইকে শনিবার রাতেই থানা হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনার বিস্তারিত জানতে সরেজমিন ঘুরে মুসলিম হওয়া পরিবার, স্বজন ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সিডনি নিউজ এর রামগঞ্জ প্রতিনিধি আজিজ ইকবাল । এছাড়াও এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাহফিলের আয়োজক কমিটি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সিডনি নিউজের সম্পাদক আব্দুর রহিম হাওলাদার(রাজু)
পরিবার ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, জন্মসূত্রে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের ৪নং ইছাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন মো. মনির হোসেন (৩৯)। নারায়নপুর গ্রামের ডাক্তার আঃ হাই বাড়ীর মৃত আব্দুল মজিদ ও মোসাম্মদ ফাতেমা বেগম দম্পতির ছেলে। মা ফাতেমা বেগম ইছাপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১নং (১,২,৩) ওয়ার্ডের সদস্য। প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান মনির।
ভারতে গিয়ে সংকর অধিকারী পরিচয়ে কয়েক বছরের ব্যবধানে রেখা অধিকারী ও সুজাতা অধিকারী নামের দুই চাচাতো জেঠাতো বোনকে বিয়ে করেন। দুই স্ত্রীর সংসারে তার ৮ ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়। পরিবার নিয়ে ভারতেই বসবাস করতেন মনির হোসেন। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে তার পরিবার ও স্বজনদের সাথে যোগাযোগ হয়। সম্প্রতি কয়েক মাস আগে দুই স্ত্রী এবং সন্তানাদী নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে রামগঞ্জে নিজের পিতৃবাড়িতে গেলে তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা মুসলিম না হওয়ায় মা ফাতেমা বেগম তাদেরকে বাড়িতে জায়গা দেননি। পরে তারা কেরাণীগঞ্জের শুভাঢ্যায় বাসা ভাড়া করে বসবাস শুরু করেন এবং গতবছরের ডিসেম্বরের ১১ তারিখে মুসলিম পরিচয়ে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দুই স্ত্রী ও সন্তানদের জন্মসনদ তৈরি করেন। সেখানে ছেলে মেয়েদের মুসলিম পরিচয়ে স্থানীয় মাদরাসায় ভর্তিও করেন। এর আগে গত অক্টোবরের ১৯ তারিখে ৪নং ইছাপুর ইউনিয়ন থেকে নিজের জন্মনিবন্ধন করেন।
এমনকি ৩ বছর আগে ভারতে থাকাকালীন সময়ে বড় মেয়ে শেফালী বেগমকে দেশে পাঠিয়ে নিজের বোন পারভিন বেগমের ছেলে পারভেজ হোসেনের সাথে বিয়েও দেন মনির হোসেন। মেয়ে শেফালী ও পারভেজের ঘরে নাতী আঃ রহমান নামে তার এক নাতিও রয়েছে।
এ ব্যাপারে শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী মো. ইকবাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ওই সময় (নিবন্ধনভুক্তির সময়) দেশের বাইরে ছিলাম। বিষয়টা আমার জানা নেই। তারা এখানে (কেরাণিগঞ্জে) মুসলমান হয়েছিলো কিনা বা নিবন্ধনের ব্যাপারে পরিষদ সচিবের সাথে কথা বলে হয়তো জানাতে পারবো’।
স্থানীয়রা বলছেন, যেহেতু তার স্ত্রী ও সন্তানদের মুসলিম পরিচয়ে জন্ম নিবন্ধন রয়েছে সেহেতু তারা সবাই আগে থেকেই মুসলিম ছিলো। সুতরাং মাহফিলে নতুন করে হিন্দু পরিচয়ে মুসলিম হওয়ার ঘটনা মিথ্যাচার ও প্রতারণা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারীর মাহফিলে মনির হোসেন নিজেকে সংকর পরিচয়ে দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এসময় তার প্রথম স্ত্রীকে রেখা অধিকারী ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে সুজাতা অধিকারী এবং প্রথম স্ত্রীর ঘরের মেয়ে শেফালী বেগমকে শ্যাফালী, মরিয়মকে মিতালী, মারিয়াকে রুপালী, নুসরাতকে কোয়েল, জান্নাতকে শ্যামলী এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের ছেলে আঃ করিমকে রাজা, মেয়ে আয়েশাকে সুমা, ছেলে আবদুল্লাকে রাজেস পরিচয়ে কালেমা পাঠ করিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করান।
এছাড়াও বড় মেয়ের ঘরের নাতি আঃ রহমানকেও সূর্য নাম দেখিয়ে কালেম পাঠ করানো হয়। সেই হিসেবে ওইদিন মোট ১২ জনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়।
এই ঘটনায় গতকাল শনিবার থেকে রামগঞ্জ উপজেলাব্যাপী তুমুল আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কেবল রামগঞ্জ বা জেলা শহর লক্ষ্মীপুরেই সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সারাদেশে বিষয়টি সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিশেষ একটা শ্রেণী মনির হোসেনকে ব্যবহার করেছে। তারা মনির হোসেনকে মাহফিলে এনে মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারীর হাতে ইসলম গ্রহণের নাটক মঞ্চায়ন করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। মনির হোসেনও লোভে পড়ে বিশাল জনসভায় পরিচিত হয়ে আলোচনায় আসার জন্য এই সুযোগ গ্রহণ করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, মাহফিলের আয়োজকদের বেশিরভাগ লোক জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে যুক্ত। এলাকাটাও প্রায় জামায়ত অধ্যূষিত এলাকা। মনির হোসেন সম্প্রতি এলাকায় এলে তার পুরো পরিবারকে ইসলাম গ্রহণের দৃশ্য দেখিয়ে ক্রেডিট নেয়ার চেষ্টা করেছে জামায়াতের স্থানীয়রা নেতাকর্মীরা।
অপর একজন বলেন, মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারীর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে জামায়াত প্রীতি বা জামায়াত সংশ্লিষ্টতা অনুমান করা যায়। তার মাহফিলগুলো জামায়াতের লোকদের নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের সহয়তাতেই অধিকাংশ মাহফিল হয়ে থাকে। রামগঞ্জের স্থানীয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা তাদেরই একজন আলোচিত বক্তার হাতে ১১জনের মতো বিশাল পরিবারের সবাইকে ইসলাম গ্রহণের দৃশ্য দেখিয়ে দলীয় ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে এই নাটক মঞ্চায়ন করেছে।
রামগঞ্জ উপজেলার ৫নং চন্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার মোঃ ইব্রাহিম মিয়া বলেন, মনির হোসেন ইছাপুর ইউপির সংরক্ষিত মেম্বার ফাতেমা বেগমের বড় ছেলে এবং দক্ষিন নারায়নপুর আঃ হাই ডাক্তার বাড়ির মজিবুল হকের ছেলে হলেও কয়েক মাস যাবত হরিশ্চর গ্রামের হাফেজ আয়াত উল্যাহর বসত ঘরে ভাড়া থাকতো। তার দুই কন্যা জান্নাত ও আয়েশা আক্তার হরিশ্চর দাখিল মাদ্রাসার ৫ম শ্রেনীর এবং ছেলে আব্দুল্লাহ বর্তমানে নুরানী মাদরাসায় পড়াশুনা করছে।
গ্রামের লিটন হাজারীসহ কয়েকজন বলেন, ১১ জনের মুসলমান নিবন্ধন থাকার পরও শুক্রবার মিজানুর রহমান আযহারীর মাহফিলে মনির হোসেন নিজেকে সংকর অধিকারী, প্রথম স্ত্রীকে রেখা অধিকারী ও দ্বিতীয় স্ত্রীকে সুজাতা অধিকারী এবং সন্তানদেরকেও হিন্দু পরিচয় দিয়ে কালেমা পড়িয়ে মুসলমান বানানো হয়।
এব্যাপারে জানতে চাইলে মনির হোসেন বলেন, আমি ভারতে থাকাবস্থায় সংকর অধিকারী পরিচয় দিতাম। দেশে ফিরে পূর্বের পরিচয় দিয়ে একটি অটোরিক্সা চালিয়ে দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে জীবন-যাপন করছি।
মনির হোসেনে মা ৪নং ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের সদস্য মোসাম্মদ ফাতেমা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ছেলে ২৫/৩০ বছর আগে ভারতে চলে যায়। সেখানে বিয়ে করে। নাম দেয় সংকর অধিকারী। ভারতে যাওয়ার ৭/৮ বছর পরে আমাদের সাথে যোগাযোগ হয়। কয়েক মাস আগে সে বউ-বাচ্চা নিয়ে দেশে ফিরে। কিন্তু তারা হিন্দু হওয়া আমরা বাড়িতে জায়গা দেইনি। বলেছি যদি মুসলাম হতে পারিস, সবাই মিলে আমাদের ধর্ম অনুযায়ী নামাজ, রোজা করতে পারিস তাহলে মেনে নিবো। এর সে কেরাণিগঞ্জে চলে যায় সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকে’।
মাহফিল পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ও রায়পুর এল এম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তারা যে আগে থেকেই মুসলমান ছিল এ বিষয়ে আমাদের জানা ছিল না। মাহফিলের শেষে বিষয়টি আলোচনা আসার পরে বিস্মিত হয়েছি। পুলিশ ওদের আটক করে হেফাজতে রেখেছে। বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। এই মুহুর্তে আমি বেশি কিছু বলতে পারবো না’।
উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টন ঐক্য পরিষদের সভাপতি অপুর্ব কুমার সাহা বলেন, ‘তার মা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মেম্বার, সন্তানেরা মাদরাসাতে পড়ে, বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন মুসলিম পরিচয়ে মুসলিম ছেলের সাথে, জম্ম নিবনন্ধনে সবার পরিচয় মুসলমান হওয়ার পরেও কীভাবে মাহফিলে গিয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান ধর্ম গ্রহন করে। এটি নাটক ছাড়া কিছুই নয়। বিষয়টি কেন্দ্রে জানানো হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশনা পাওয়ার পরে পরবর্তি কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে’।
রামগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ১১জনকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। বিষয়টি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ায় নেওয়া হবে।
বি.দ্র. : সিডনি নিউজে প্রকাশিত পূর্বের সংবাদে মনির হোসেনের বয়স ৩৯ উল্লেখ্যপূর্বক তার ভারতে যাওয়ার সময়কাল বলা হয়েছিলো ৩৫ বছর আগের। মূলত বয়স নিয়ে এলোমেলো তথ্যের জন্য তাদের পরিবার দায়ী। তারা যখন ২৫/৩০ বা ৩০/৩৫ বছর বলে তখন এ বৈপরিত্য তৈরি হয়। তার বয়সের ব্যাপারে ৪৭ বছরের একটা বক্তব্যও পাওয়া গেছে। ৩৫ বছর আগে ভারত গিয়ে থাকলে তার বয়স ৪৭ ধরলে বিষয়টা স্বাভাবিক। কিন্তু বয়স ৩৫ ধরলে তার মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী ২৫ বা ৩০ বছর আগে ভারতে যাওয়া ধর্তব্য হবে।
Leave a Reply