বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীর জীবনে ধর্ষণ কখনো শেষ হয় না। নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে সে পরোক্ষ ধর্ষণেরই শিকার হতে থাকে। মামলা, তদন্ত, সাক্ষ্য গ্রহণ, বিচার প্রত্যেকটি পর্যায়েই যেন পরোক্ষ ‘ধর্ষণের শিকার হয়’ নারী।
পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়।
ধর্ষণের শিকার একজন নারী বিচার চাইতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই আবারও পরোক্ষভাবে জনসমক্ষে ধর্ষণের শিকার হন। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তাঁর সহযোগীদের এ রকম সুযোগ করে দেয়। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।’ অর্থাৎ অভিযোগকারীকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। একবিংশ শতকেও বাংলাদেশে এখনো এ রকম আইন রয়েছে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন এক সেমিনারে বক্তারা।
২০১৬ সালের ৫ই জুন বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে ধর্ষণ মামলায় নারীদের চরিত্র হননের সুযোগ করে দেওয়া এই ১৫৫(৪) ধারা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ধর্ষণের শিকার নারী আমাদের সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারা কারও বোন, কারও কন্যা, কারওবা স্ত্রী, যে পরিবারের কোন একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন সে পরিবারের প্রতিটি সদস্য এর ব্যথা যে কতটা ভয়ানক ও মর্মস্পর্শী তা অনুভব করেন।
একজন নারী প্রথমবার ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গেলে দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হন থানায়, শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গেপড়া আতংকগ্রস্ত নারীকে স্পর্শকাতর নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়িত্বরত পুরুষ কর্মকর্তা। যা উক্ত নারীকে আরও বেশী আতংকিত ও বিপর্যস্ত করে তোলে। এটি তার দ্বিতীয়বার ধর্ষণ।
এরপর ধর্ষণের দিন বৃহস্পতি বা শুক্রবার হলে তাকে আরও দুদিন অপেক্ষা করতে হয় পরীক্ষার জন্য। এরমধ্যে ধর্ষণের আলামত নস্ট হয়ে যায়।
পরবর্তীতে যখন ধর্ষিতাকে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় সেখানেও তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পুরুষ চিকিৎসক কর্তৃক দুই আঙ্গুলের তথাকথিত ‘অযৌক্তিক’ পরীক্ষার শিকার হন। ওই পরীক্ষা ভিকটিমকে আবার ধর্ষণ করার শামিল। সেই নারী বিবাহিত হলে টু ফিঙ্গার টেস্টে আদৌ কিছু বোঝা সম্ভব নয়।
একটা কথা বলে রাখি, টু ফিঙ্গার টেস্ট পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ব্যবহার করা হয় না। কারন এই পরীক্ষা পদ্ধতি খুবই অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক, সনাতন ও সামাজিকভাবে বিতর্কিত। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বহু আগে এই মেডিকেল পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। সেখানে আইন করা হয়েছে, ধর্ষিতার গোপনাঙ্গ ডাক্তারের সামনে কেবল চিকিৎসার জন্যই উন্মোচিত হতে পারে, নিরীক্ষার জন্য নয়।
ওই দুই পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের পরীক্ষা করার সময় একজন গাইনোকলজিস্ট, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, নারী পুলিশ কর্মকর্তা এবং প্রয়োজনে ভিকটিমের একজন নিকট আত্মীয়কে সেখানে রাখতে হবে।
ভুক্তভোগী সেই নারী পরেরবার ধর্ষণের শিকার হন সয়ং আদালতে, আমাদের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণতঃ ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ঐরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
এ ধারাটি আদালতের কাজে এলেও বর্তমানে ধর্ষিতার ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাকীর্ণ আদালতে ধর্ষিতাকে হেনস্তা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এই আইনকে। একজন ধর্ষিতা আদালতে বিচার চাইতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবারও ধর্ষণের শিকার হন। কারণ এ ধারা প্রয়োগ করলে ধর্ষিতার অতীত যৌনজীবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় একটি বিষয়। প্রতিপক্ষের আইনজীবী বার বার প্রমাণের চেষ্টা করেন আসলে ধর্ষিতা এ রকমের যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত। খোদ একটি আইনের ধারাই যেখানে ধর্ষিতাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে। সেখানে ওই ধর্ষিতাকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে।
ভুক্তভোগী ধর্ষিত নারী শেষবার ধর্ষিত হতে থাকেন নিজ পরিবারেও সমাজে। আর এ যন্ত্রণা সইতে না পারে অধিকাংশ ধর্ষণের শিকার নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে আমাদের সমাজ ও রাস্ট্র ব্যবস্থাকে মুক্তি দিয়ে যান।
লেখকঃ আবুল কালাম আজাদ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Leave a Reply