ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁই ছুঁই,আজকের রাতটা যেনো কাটছেই না!সেই কখন থেকে নিলান্তী জানলার পাশে বসে আকাশের চাঁদটাকে বিচার বিশ্লেষন করে যাচ্ছে!অপেক্ষা একটা মিষ্টি সকালের,সারা জীবন সে এই সকালের অপেক্ষা করে এসেছে!অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো।কিন্তু কি অদ্ভুত, আজকের রাতটাই যেনো তার জীবনের সবচেয়ে বড় রাত!কিছুতেই রাতের অন্ধকার কাটিয়ে পূবের আকাশে সূর্য মশাইয়ের দেখা মিলছে না।আজ বোধহয় পূর্ণিমা রাত হবে,তাইতো আকাশে এতো সুন্দর রুটির মতো চাঁদ উঠেছে!আচ্ছা আশেপাশের সবাই বলে নিলান্তির মা খু্ব খারাপ,সত্যিই কি তার মা খারাপ!কই ছবি দেখে তো কখনো মানুষটাকে খারাপ মনে হয় নি তার,কতো স্নিগ্ধতা সে ছবিতে!ভাবতেই মনটা এক অজানা খুশিতে ভরে যাচ্ছে নিলান্তীর।অবশ্য নিলান্তীর নানুভাই বলেন, “তোর মা আমার সন্তানদের মধ্যে খুব প্রিয় ছিল জানিস!কেনো যে মেয়েটাকে জীবনে এতো কষ্ট দেখতে হলো!”।প্রায়ই খুব আফসোস করেন তিনি।তবে খোলাসা করে কখনোই নিলান্তীকে এবাড়ির কেউ তার মায়ের ব্যপারে কিছু জানায় নি!সবাই তাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে,তাইতো আগ বাড়িয়ে নিলান্তীও কিছু জানতে চায় নি।তবে মাঝেমাঝেই ইচ্ছে হতো মায়ের তাকে ছেড়ে যাবার কারন জানতে…..সে নিয়ে মনের মাঝে হাজার আক্ষেপ থাকলেও আজ তার বিন্দুমাত্র রেশ নেই নিলান্তীর মনে!তার মা আসছে,তার নিজের মা,তার কল্পনার সেই আসল মা!এটাই কি তার জন্য যথেষ্ট নয়!
সেই ছেলেবেলায় বাবার সাথে মা’র ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকেই সে নানু বাড়িতে বড় হয়েছে। বয়স তখন আর কতোই বা হবে, বড়জোর এক বছর। তারপর মা অন্যজনকে বিয়ে করে বিদেশে চলে গিয়েছিল। তাঁর ছবি দেখেই মনের মধ্যে একটা মাকে চিত্রিত করে নিয়েছে সে। মা আসছে, কি যে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে! আচ্ছা, সবার মায়ের মতো আমাকেও ওভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে তো আমার মা? নাকি, না চেনার ভান করে মুখে ফিরিয়ে থাকবে। না, না, কি ভাবছি এসব, মা কখনও এমন হতেই পারে না। মা মানেই তো মমতাময়ী একজন নারী।আমার মা নিঃশ্চই আমার মতোই উতলা হচ্ছেন আমার সঙ্গে দেখা হবে বলে!হয়তো এতোদিনের জমানো সব কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন!আচ্ছা,আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মায়ের গলার স্বর কি ভারী হয়ে আসবে?তিনি কি কেঁদে দেবেন?কি করা উচিত আমার,মাকে দেখেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত?নাকি অভিমান করে দুরে সরে থাকা উচিত?এমন হাজারো কথা নিলান্তীর ছোট্ট মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে!অনেকেই বলেছে,নিলান্তী তার মাকে সহ্য করতে পারবে না।দুরে ঠেলে দেবে…..সবার সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিলান্তী অতি আগ্রহে তার মায়ের অপেক্ষা করছে।দূরে থাকলেই কি মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলা যায়?
সকাল সাতটা। নীলান্তী জানতে পেরেছে ছটা পঞ্চান্নতে ফ্ল্যাইট ল্যান্ড করবে দমদম এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে গাড়ি করে অাসতে এই মোটামুটি ঘন্টা খানেক। ব্যাস অার কিছুক্ষণ তার পর মায়ের সাথে দেখা হবে!ও কী উত্তেজনা হচ্ছে।না অাজ কিছুতেই কলেজ যাবে না সে। ফোনটা তুলে কল দেয় সায়ণ কে।
– হ্যালো…
– হ্যালো…
-বলছি শোন না অাজ অার দেখা হবে না। জানিসতো মা অাসছে বহু বছর পর। অাজ অার কলেজ যাবো না।
– বলছি তা হলে অামাদের সিনেমা প্ল্যান কী হবে?টিকিট তো কাটা হয়ে গেছে?
– কোনো মতেই আজ হবে না রে।প্লিজ রাগ করিস না।
রাখছি রে রাতে কথা হবে। সারাদিন অার সময় দিতে পারবো না তোকে।
– শোন! শোন! অারে! যা কেটে দিল।
ফোনটা রেখেই সোজা বার্থরুমে ঢুকে পড়ে নীলান্তী।চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নেয়।তার হিসাবমতে জ্যাম না পড়লে এতোক্ষনে তার মা বাড়ি চলে এসেছে।আর না আসলেও নাস্তা করা অবধি ঠিক চলে আসবে….যত সময় গড়াচ্ছে উত্তেজনা ততো চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে…..!
হঠাৎই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে আসে নিলান্তীর কানে।উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপছে।কি প্রতিক্রিয়া দেবে, সে হিতাহিত জ্ঞান যেন সে হারিয়ে ফেলেছ!সে এক দৌড়ে বসার ঘরে পৌঁছে যায়!দুর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে তার নানুমনি এক মধ্যবয়স্কা মহিলাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলছেন।কাওকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়নি,নিলান্তী বুঝে নিয়েছে এটাই তার মা….তার কল্পনার সঙ্গে যেনো হুবহু মিল খুঁজে পাচ্ছে মানুষটির! তার মধ্যেই নানুভাই বাণী…বাণী…বলে ছুটে এলো।নীলান্তীকে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাণী নিজেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে…..প্রথম প্রথম একটু ঘাবড়ে গেলেও নিজের মাকে এতো কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরার লোভ নিলান্তীও সামলাতে পারলো না।মাকে শক্ত করে ধরে আঠারো বছরের সব ক্লান্তি মুছে ফেলে আকাশ ফাটা আর্তনাদে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো।সকলেই মা আর মেয়ের এমন পরম ভালোবাসা দেখে আশ্চর্য হলো। এতোটা বছর পরেও এমন ভালোবাসা কি করে আসে!মা’র ভালোবাসা বুঝি সারাজীবনের ক্লান্তিকেও মুছে দিতে পারে। তারপর সবাই একসঙ্গে নাস্তা শেষ করে বাণী আর নিলান্তীকে একা ছেড়ে দিলো।কাটাক না কিছু মূল্যবান মুহুর্ত তারা একত্রে!নিলান্তীকে সবাই ভালোবাসলেও তার জীবনে মায়ের অভাবটাতো কেউ পূরন করতে পারে নি!এবার নাহয় বাণীর আগমনে নিলান্তীর সে অভাবের জায়গাটা পূর্ণতা পাক!
নীলান্তি তাঁর মাকে নিয়ে নিজের রুমে গেলো। মাকে খাটের উপর বসিয়ে আলমারি থেকে একটা বাক্স বের করলো। এই বাক্সটিতে জমা হয়ে আছে নীলান্তির শৈশবের স্মৃতি। মিসেস বাণীর চোখদুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে। এই অশ্রু নিজের সন্তানকে এতো বছর নিজের থেকে দূরে রাখার বহিঃপ্রকাশ।আজ তার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে নিলান্তীকে নিজের থেকে দুরে সরিয়ে রাখার জন্য!নীলান্তি বাক্সটি খুলে একে একে তার শৈশবের সমস্ত স্মৃতি মিসেস বাণীর সামনে উপস্থাপন করছে। নিজের মেয়ের চোখেমুখে মাতৃস্নেহের অভাব অনুধাবন করতে পেরে বার বার নিজেকে দুষছেন মিসেস বাণী। নীলান্তি কাঁদো কাঁদো গলায় ছোট্ট জামাটি হাতে নিয়ে বলতে লাগলো “মা দেখো!তোমার হাতের আদরে মাখা জামাটি এখনো কতো যত্নে রেখেছি আমি..মা তুমি জানো, যখনি তোমাকে খুব মনে পড়তো এই জামাটি জড়িয়ে ধরে ঘুমোতাম..মনে হতো তোমার গায়ের গন্ধ এতে মিশে আছে।জানো মা,আমি না আমার সব খেলনা,প্রিয় জামা,বইগুলো রেখে দিয়েছি।তুমি তো আমার শৈশব দেখো নি,তাই তোমাকে দেখাবো বলে রেখে দিয়েছি সব!” নীলান্তি ফ্লোরে বসে তাঁর মায়ের কোলে মাথা এলিয়ে দিলো।
মিসেস বাণীর চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছে। খুব বেশি অপরাধবোধ কাজ করছে তার ভেতরে।পারবে কি কখনো এই অপরাধবোধ থেকে মিসেস বাণী নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে!
মিসেস বানী নীলান্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, খুলে বলবে কি সে, কেনো নিলান্তীকে রেখে পাড়ি জমাতে হয়েছিল বিদেশে!কেনো মা হয়ে সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারেন নি!সবটা ভেবে সত্যিই ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ তাছাড়া,মেয়ের সুখের জন্যইতো তাকে মা-বাবার কাছে রেখে,অন্যজনকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন মিসেস বাণী।মেয়ে কি তার ত্যাগটা অনুধাবন করতে পারবে!বিদেশে থেকেও প্রতিদিনই নীলান্তীর খোঁজ-খবর নিতেন মিসেস বাণী। নীলান্তী মায়ের কোলে মাথা রেখে ভাবছে, কেনো একা রেখে চলে গিয়েছিলো তার মা তাকে?কেনো মায়ের আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হতে হলো তাকে?নীলান্তির মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।আজকেই কি জিজ্ঞেস করবে মাকে!না,না আজ থাক।অবশ্য মাকে পেয়ে গেছে।এবার এসব প্রশ্নের উত্তর না হলেও চলবে নিলান্তীর! মুচকি হেসে মায়ের কোলে মুখ লুকায় নিলান্তী।আজ সারাদিন মায়ের কোলে মাথা রেখে প্রান জুড়াবে সে!
সন্ধ্যার দিকে ফোনের রিংটোন শুনে ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে বিছানায় উঠে বসলো নিলান্তী।অনেক বছর পর এমন শান্তীর ঘুম ঘুমিয়েছে সে!ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকালো….
—হ্যাঁ,সায়ণ বল….
—কেমন কাটলো মা মেয়ের মিলনের দিন?এই অধমকে তো আর কারো মনেই নেই!
—না রে…..ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…..
হঠাৎ কারো কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে গেলো নিলান্তী!
—বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে রে…..আমি একটু পরে কথা বলছি তোর সঙ্গে…..
—আরে নিলান্তী…..
যাহ,কেটে দিলো!
বসার ঘরে সবাই জড় হয়ে বসে আছে।নানুমনি আচলে মুখ গুঁজে কাঁদছেন!নিলান্তীর মা’ও কাঁদছে!একদলা কান্না নিলান্তীর গলায় এসে বেধে আছে।যখন তখন আছড়ে পড়বে দু’চোখ বেয়ে নোনা জল!
—কি হয়েছে নানুমনি?তুমি কাঁদছো কেনো?
—তোর মা আমাদের না জানিয়ে তোর মামাদের সঙ্গে মিলে সব ঠিক করে ফেলেছে।
নানুমনির কান্নার বেগ ক্রমশই বাড়ছে….
—কি ঠিক করেছে?
—তোকে তোর মা নিতে এসেছে।আগামী কাল সন্ধ্যায়ই তোদের ফ্লাইট!
মুহুর্তের মধ্যে নিলান্তীর এতোদিনের সাজানো স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেতে লাগলো!সারাজীবন সে মা’কে চেয়েছে,মায়ের জন্য অপেক্ষা করেছে,কিন্তু সায়ণ বা নানু বাড়ির সবাইকে ছেড়ে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবে নি!
গলার কাছে আটকে থাকা কান্নার দলা এবার নিলান্তীর চোখের কোন বেয়ে পড়তে শুরু করলো।
মিসেস বাণী নিলান্তীর কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,পরম স্নেহে বললেন,
—যাবিনা আমার সঙ্গে নিলান্তী মা!
মায়ের এ স্নেহের ডাক উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস নিলান্তীর নেই।হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে যায় নিলান্তী।মুঠোফোন হাতে ফোন লাগায় সায়ণকে!এ মানুষটা যে এতো বছর তার সব দুঃখে ঢাল হয়ে পাশে ছিলো।তবে আজ কি করে বলবে যে সে চলে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে!
—বল কি বলবি?
—সায়ণ!
নিলান্তী কাঁদছে….বুঝতে বাকি নেই শায়নের।তবুও নিজেকে শান্ত করে নিলান্তীকে জিজ্ঞেস করলো…..
—কাঁদছিস কেনো?কি হয়েছে আমাকে বল….
—মা আমাকে নিতে এসেছে।আমি কাল মায়ের সঙ্গে চলে যাচ্ছি!
—এ তো খুশির খবর।কাঁদছিস কেনো বোকার মতো?
—নানু বাড়ির সবাইকে ছেড়ে,তোকে ছেড়ে আমি কি করে থাকবো দুরদেশে?
—ভেবেছিলাম বরযাত্রীটা নিয়ে এ দেশেই যেতে হবে কিন্তু উপরওয়ালা তো আমার উপর বড়ই প্রসন্ন।তাইতো বিদেশে বরযাত্রী নিয়ে যাবার সৌভাগ্য করে দিলেন।শ্বাশুড়ি মাকে আমার হয়ে একটা চকলেট দিয়ে দিস তো!তুই নিশ্চিন্তে যা।তোকে নিতে এই সায়ণ আসবে!
ফোনটা রেখে মুচকি হাসলো নিলান্তী।এ হাসি উপহাসের নয় ভরসার!সে জানে সায়ণ ঠিক তার কথা রাখবে!অন্যদিকে সায়ণের ঠোঁটের কোনেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো।নিলান্তীকে যে আর কখনো মায়ের অভাবে কাঁদতে হবে না তা ভেবেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সায়ণ!
সমাপ্ত
Leave a Reply