মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বিবন্দী গ্রামের এক দারিদ্র কৃষকের সন্তান এই লিটন। রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে শেষ দর্শন আজমেরি জেমস হাউজ নামে তার জ্যোতিষশাস্ত্রের সদর দফতর। এটি আবার সব মুসকিল আছান দফতর নামেও পরিচিত। কেউ কেউ বলেন, জিন্দা পীরের দরবার। ভক্তদের কেউ আবার পাগলা বাবার দরবার বলতেও পছন্দ করেন। কিন্তু নাম যাই হোক না কেন, কাজ নিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব তথ্য ও প্রমাণ। এখানে মূলত মানুষের ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে লিটন দেওয়ান রীতিমতো বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালুর’ কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদের মতো ‘মাজার’ খুলে বসেছেন। নিজেকে বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ দাবি করে দু’হাতে খালি করে চলেছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের পকেট।
খবরের কাগজে ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দিনরাত মিথ্যার বেসাতির মতো লিটন দেওয়ানের গুণগান ও মহত্ত্বকথা ছড়িয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। লিটনের সাক্ষাৎকার ছাপানো হচ্ছে অখ্যাত বিভিন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনেও।
আবার শুধু টাকার জন্য এই প্রতারকের বিজ্ঞাপনে মডেল হতে দেখা গেছে নামিদামি অভিনেতাকেও। সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে লিটনের প্রতারণার চেম্বার। ডাক্তারের ফি’র মতো লিটন দেওয়ানের কর্মচারীরা সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নাম খাতায় এন্ট্রি করে প্রত্যেকের কাছ থেকে আগাম ফি নিচ্ছেন। জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। ভরদুপুরে সিরিয়াল নম্বর ৯২ দেখে তো ঈগল টিমের সদস্যরা রীতিমতো হতবাক। ‘৯৩ নম্বরে সিরিয়ালে সাক্ষাৎ পেতে হলে রাত ১২ টাও বেজে যেতে পারে।’ কিছু সুবিধার বিনিময়ে সিরিয়াল কমিয়ে ৩৫ করা গেল। এবার দীর্ঘ অপেক্ষার পালা।
মাথা সাপের মতো আকৃতির পেচানো পাগড়ি আর পরনে সাদা পাঞ্জাবি উপর কটি পরিহিত জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান বসে আছেন কাচঘেরা বিশেষ একটি সুসজ্জিত কক্ষে। অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ তো একেবারেই নিষিদ্ধ। সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ চেম্বারের বাইরে অপেক্ষমাণ। যাদের বেশী ভাগ লোকজনই বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের। শুধুমাত্র টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখেই তারা এখানে এসেছে। আগে-পরে ঢোকা নিয়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় রীতিমতো ঝগড়াও হচ্ছে। ঝগড়া সামাল দিচ্ছেন লিটনের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা। একজন নারী দর্শনার্থী লিটন দেওয়ানের ব্যক্তিগত কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলেন, গতবারে এসে ফেরত গেছি। ভিড়ের কারণে ‘বাবার’ সাক্ষাৎ পাইনি। এবার একটু তাড়াতাড়ি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন ভাই। এ অনুরোধ শুনে লিটনের এক কর্মচারী রীতিমতো ওই নারীকে কড়া ধমক দিলেন। আপনাকে আগে পাঠালে অন্যরা কি বলবে। চুপচাপ বসে থাকেন। সিরিয়াল এলে তবেই ভেতরে ঢুকতে পারবেন। ধমক খেয়ে টুপসে যান ওই নারী।
কুমিল্লা থেকে এক নবদম্পতি এসেছেন লিটনের সাক্ষাৎ পেতে। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে সমস্যা জানতে চাইলে তারা জানালেন, মাত্র এক বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে সুখী নন। নানা সমস্যা হচ্ছে। জিন-পরীর কু-নজর পড়েছে মনে করে তারা ‘লিটন বাবা’র কাছে ‘তদ্বির’ নিতে এসেছেন। আরেকজন সৌদি প্রবাসী নারী দর্শনার্থী এসেছেন। পরকীয়ার কারণে তার সংসার ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিকার পেতে তিনি বাবার আস্তানায় এসেছেন। একজন ব্যবসায়ী এসেছেন তার ব্যবসা ভালো করার তদবির নিতে। লিটন দেওয়ান এসব দর্শনার্থীর কাছ থেকে একের পর এক এসব সমস্যার কথা শুনে সমানে সরকারি হাসপাতালের প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেয়ার মতো পাথর, আংটি ও তাবিজ দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ১০০ পার্সেন্ট গ্যারান্টি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা ৭টায় আমাদের ৩৫ন নম্বর সিরিয়ালের ডাক পড়ল। পরিচয় গোপন করে চেম্বারের ভেতরে লিটন দেওয়ানের মুখোমুখি সিডনিনিউজের দুই সদস্য। কিন্তু তার কক্ষে ঢুকে অনেকটা বিস্মিত হতে হল। ঘরময় নানা ধরনের পুরস্কার, ক্রেস্ট আর মন্ত্রী-এমপিসহ গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে লিটনের তোলা ছবি দিয়ে সাজসাজ অবয়ব। ঘরে বড় করে টানানো আছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লিটনকে দেয়া সম্মাননা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট। বিশাল এক বিলাসবহুল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন কথিত জ্যোতিষ রাজ লিটন। কক্ষের ভেতরে ঢোকামাত্র বিশেষ ভঙ্গিতে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। ইশারায় বসতে বললেন। সালাম ও নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিটন দেওয়ানকে বলা হল, ‘চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে। যেভাবেই হোক এবার বিসিএস পরীক্ষায় চান্স পাওয়াতেই হবে। সমস্যা শুনে দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ফেললেন লিটন। বললেন, তোর সমস্যা অনেক জটিল। তবে আমি সমাধান দেয়ার ওছিলা মাত্র। সব সমাধান দেবেন (উপরের দিকে একটা আঙুল তুলে) তিনি। কোথায় থাকি, নাম পরিচয়, বাবার নাম ইত্যাদি জানতে চাইলেন। এরপর রাশি নির্ধারণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে আতশি কাচ দিয়ে উল্টেপাল্টে হাত দেখলেন।
এরপর বললেন, শনির রাহু গ্রাস করেছে। রাহু কাটাতে নীলা (পাথর) আংটি পরতে হবে। আংটির দাম ১৫ হাজার টাকা। এই আংটি পরলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ সবকিছু শুনে কিছুটা খুশি হওয়ার ভান করলাম। এরপর আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতেই বাইরে থাকা লিটনের কর্মচারীরা ঘিরে ধরলেন। তাদের বক্তব্য-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ, এখন টাকা দেন, পাথরের আংটি নিয়ে যান।’ এত টাকা সঙ্গে নেই জানিয়ে কিছুক্ষণ পরে আসার কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। এসময় আরো জানা গেল, প্রতিদিন লিটন দেওয়ানের কাছে গড়ে দেড়শ’ মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসেন নানা সমস্যা নিয়ে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫শ’ টাকা করে শুধু দর্শন ফি বাবদ দৈনিক অন্তত ৭৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। মাসের হিসাবে এই অংক সাড়ে ২০/২২ লাখ, বছরে পরিমাণ দাঁড়ায় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। লিটন নিজেই বলেছেন, ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন তিনি।
লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনে অনেক নামিদামি চিত্রতারকারা বলেন, তারা ‘দেওয়ান সাহেব’র কাছে এসে উপকৃত হয়েছেন। তাদের অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে।’ এসব চিত্রতারকার মধ্যে আছেন শীর্ষস্থানীয় চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎ, নায়ক জাবেদ, প্রবীর মিত্র, খল অভিনেতা আহমেদ শরীফ, চিত্র নায়িকা রতœা, অভিনেত্রী খালেদা আক্তার, রিনা খান, চিত্রনায়ক হেলাল খান ও অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী সহ আরো অনেকে। বিজ্ঞাপন দৃশ্যে চিত্রনায়ক হেলাল খানকে বলতে দেখা যায়, ‘আমাকে উনি (লিটন দেওয়ান) একটা পাথরের আংটি দিয়েছেন। আমি উপকার পেয়েছি। আপনারাও আসুন, আমার মনে হয় উপকার পাবেন।’ বিশিষ্ট অভিনেত্রী রিনা খান বিজ্ঞাপনে বলছেন, ‘জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ানের কাছ থেকে এই পাথর কিনে ব্যবহার করি। এই পাথর ব্যবহার করার পরে আমার জীবনে সুখশান্তি ফিরে আসে। আপনারাও এই পাথর ব্যবহার করুন। এই পাথর আসল পাথর। জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ান মানুষের মুখ দেখেই তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন।’
বর্ষীয়ান অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীকে বিজ্ঞাপনে বলতে দেখা যায়, ‘কোন সমস্যায় কি সমাধান দিতে হবে এটাই তার সাধনা। আপনার সমস্যাগুলো তাকে বলুন। নিশ্চয় আপনি উপকৃত হবেন।’ চিত্রপরিচালক কাজী হায়াৎকে বলতে দেখা যায়, ‘লিটন দেওয়ান একজন নামকরা জ্যোতিষ। তার কাছ থেকে একটি পাথর নিলাম। দেওয়ান সাহেব বললেন, আপনি এই পাথরটি পরবেন। আপনার জীবনে সাফল্য আসবে।’ চিত্র নায়িকা রত্নাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি আমার জীবনের নানা সমস্যা উনাকে (লিটন দেওয়ান) বললাম। সব শুনে তিনি আমাকে দুটি আংটি দিলেন। আংটি দুটি আমি ব্যবহার করছি। এখন আমি অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ খল অভিনেতা আহেমদ শরীফ বলছেন, লিটন দেওয়ান একজন গুণী ব্যক্তি। তার পিতাও একজন বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন (অথচ অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিটনের পিতা শ্রীনগর উপজেলার বিবন্দী গ্রামের একজন অশিক্ষিত কৃষক মাত্র)। তার পিতার মাজার শরিফের ঔরস অনুষ্ঠানে আমি নিজে যাই। আপনারাও যাবেন। লিটন দেওয়ানের কাছে এসে আমি উপকৃত হয়েছি।’
এসব চিত্র অভিনেতা কি সত্যি উপকার পেয়ে এসব কথা বলছেন? নাকি শুধু টাকার জন্য শেখানো কথাগুলো ক্যামেরার সামনে মডেল হিসেবে অভিনয় করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে ঈগল টিম কয়েকজন অভিনয় শিল্পীর মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, অভিনয়ই তার পেশা। তবে একটা মান বজায় রেখেই তিনি অভিনয় করেন। লিটন দেওয়ানের বিজ্ঞাপনেও তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অভিনয় করেছেন মাত্র। কিন্তু অভিনয়ের সময় তারা তাকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিল তার সবকিছু তিনি বলেননি। যেটুকু যৌক্তিক মনে করেছেন সেটুকুই বলেছেন।
অভিনেত্রী রীনা খানের কাছে একই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অভিনেত্রী। অভিনয় করাই আমার কাজ। তবে এই বিজ্ঞাপনে তিনি একা নন, আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। এ বিষয়টাতে সবাই যে বক্তব্য দেবেন তারও একই বক্তব্য। আংটি পরার পর অভিনেতা হেলাল খান জেল খেটেছেন।
প্রতারণার অভিযোগে ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট লিটন দেওয়ানকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম ও শামীম নামের লিটন দেওয়ানের দুই সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর নিজের সব অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করেন লিটন দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জ্যোতিষ লাইনটাই পীর ফকিরী একটা ভন্ডামি আখড়া’। যারাই এসব করতাছে সব ভন্ডামি। আমরাও এর সাথে জড়াইয়া গেছি।’ চিকিৎসার জন্য আসা নি:সন্তান নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নি:সন্তান মহিলারা আমাদের কাছে কম আসে। তবে বিভিন্ন বয়সী মহিলারা আমাদের কাছে আসে। অনেক সময় আমাদের সান্নিধ্য পেতেও চায়। আমরাও লোভ-লালসায় জড়ায়ে যাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই লাইন ছেড়ে দেব। আমি অনুতপ্ত।’ র্যাবের একটি সুত্র জানান, আধ্যাত্মিক শক্তির দাবিদার এই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে বহু মানুষ। সে অলৌকিক নানা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে বলে প্রচার করত। বলা হতো, তার ঘরের ছাদের ওপর থেকে রক্তের ফোঁটা পড়ে। পরে তাদের তদন্তে দেখা গেল, সে বিশেষ কৌশলে কেমিক্যাল দিয়ে এসব প্রতারণার আশ্রয় নিত।
এদিকে লিটন দেওয়ান সিডনিনিউজ টিমকে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘ভাই, নিউজ টিউজ কইরা কি হইব? আমি তো একা খাই না। সবাই মিল্লা জিল্লা খাই। একদিন আমার অফিসে আসেন। একসাথে লাঞ্চ করবো।’ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অভিযান পরিচালনা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা তাদেরকে পাথর রপ্তানির কাগজপত্র এবং কিভাবে ভাগ্য পরিবর্তন হয় তার ব্যাখ্যা চেয়ে ছিলাম। জ্যোতিষি লিটন দেওয়ান কোন সদক্তর দিতে পারেনি। আপনারা অন্যদের ভাগ্য গণনা করেন কিন্তু আজকে যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে আমরা আসবো এটা আপনারা জানতেন না? ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নেরর জবাবে ভাগ্য গণনাকারি প্রতিষ্ঠান লিটন দেয়ানের ম্যানেজার বললেন, ‘স্যার, এই সময় আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না, জরিমানা করলে কিভাবে টাকা পরিশোধ করবো। এখন আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।
Leave a Reply