জোসেফ আজ খুব খুশি।কারন আজ তার একমাত্র মেয়ে জেনির জন্মদিন।প্রতিবছর এই দিন টি খুব ঘটা করে পালন করে জোসেফ।যদিও সেই ঘটার পরিমাণ তাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় যৎসামান্য।তবুও মা মরা একমাত্র মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তার বেতনের তলানি উপুড় করতে চিন্তা আসেনা পরের দুই সপ্তাহ জোসেফকে পায়ে হেঁটেই অফিসে যেতে হবে।এইবার তার গরীব ঘরের রাজকন্যার আঠারো তম জন্মদিন।
তাই অন্যবারের তুলনায় উদযাপন বিশেষ হওয়াই বিধেয়। উপহারটাও হতে হবে দামী।জোসেফ তার এক বন্ধুর থেকে দুইশত ডলার ধার করলো।অফিস থেকে ফেরার পথে চিন্তা করলো কি উপহার কিনবে জেনির জন্য।হাটতে হাটতে একটা জামার দোকানের সামনে এলো।দোকানের ভেতর ডলে সাজানো একটা নেভি ব্লু কালারের গাউন দেখে চোখ আটকে গেলো জোসেফের। গাঢ় নীলের মধ্যে সাদা পার্ল এর কাজ করা।
দেখতে মনে হচ্ছে গভীর রাতে জমে যাওয়া নদীর ওপর যেন তুষার পড়ছে।আর সময় নষ্ট না করে দৌড়ে ঢুকলো দোকানে।গিয়ে জামার দাম জিজ্ঞেস করে দাম শুনতেই যেন পায়ের নিচের মাটি কেপে উঠল কিছুটা।
গাউনটার দাম তিনশত ডলার! চিন্তায় পড়ে গেল জোসেফ।আজকেই সে বেতন পেয়েছে। দুইশত ডলার দিয়ে তাকে দুই সপ্তাহ চলতে হয়।এমনিতেই ধারের টাকা শোধ করতে বেশ টানাপোড়ন চলবে সামনের কয়েকমাস, তার ওপর আবার যদি যদি বেতনের টাকাটাও খরচ করে ফেলে তাহলে কিভাবে চলবে? এসব চিন্তা করতে করতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে জোসেফের তখনই তার চোখের সামনে জেনির মুখটা ভেসে উঠলো।
এই জামাটা পরে তার দুধে আলতা গড়নের মেয়ে যখন তার দিকে চেয়ে একটা মিষ্টি হাসি দেবে, তখন তার মনটা খুশিতে ভরে যাবে, একজন সফল পিতার সার্থকতার খুশি।মনে হবে দুনিয়ার সব সুখ সে কিনে ফেলেছে তিনশত ডলার দিয়ে।
” স্যার, আপনি কি গাউন টা নিবেন?” দোকানির কথায় কল্পনার ঘোর কাটলো জোসেফের।বললো,হা আমি এটা নিতে চাই।
জোসেফ ড্রেসটা নিল,তার সঙ্গে ছোট একটা কেক,কিছু চকোলেট, কয়েকটা ক্যান্ডেল আর বেলুন নিল।বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে।যাতায়াতের জন্য গাড়ির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও কিছু টাকা বাঁচবে এই চিন্তা করে জোর কদমে হাঁটা ধরলো জোসেফ।রাস্তা যেন ফুরায়না,নাকি উত্তেজনায় তার হাঁটার গতি কমে যাচ্ছে বুঝতে পারছেনা জোসেফ। অবশেষে বাড়ি পৌঁছালো।
ঘরে ঢুকেই খুব সাবধানে পা ফেলে জোসেফ।সে চায় জেনিকে একটু সারপ্রাইজড করতে।পরক্ষণেই বুঝতে পারলো সে স্বাভাবিকভাবে আসলেও কিছু হতনা কারণ জেনি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে টেবিলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিষন্নতায় ছেয়ে গেল জোসেফের মুখটা।
ইশ! কেমন বাবা আমি?
এমনিতেই মেয়ের সব চাহিদা পূরণ করতে পারিনা তার ওপর সময় মতো আসতেও পারিনা।
জেনি বোধহয় না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
উপহার গুলো একটু আড়ালে রেখে জেনিকে ডাকলো জোসেফ।
জেনি!
মাই প্রিন্সেস!
ওঠো, দেখো?
বাবা তোমার জন্য কি এনেছি?
জেনি কিছুটা রেগে ছিল বটেই,কিন্তু গিফটের কথা শুনতেই ধরফরিয়ে উঠে বললো কি এনেছ?
দেখাও?
উহ্যুম, দেবো তার আগে বলতো! ডিনার করেছ তুমি?
হ্যা করেছি, এবার দাও
শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল জোসেফ। কেক আর চকোলেট গুলো এগিয়ে দিল তার কাছে।জেনি খুব তাড়াহুড়ো করে প্যাকেটটা খুললো। কিন্তু তার এতো উত্তেজনা নিঃশেষ হয়ে গেল প্যাকেটে থাকা স্বস্তা কেক আর চকোলেট দেখে।
চেয়ার টাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল জেনি। রাগে তার মাখন বর্ণের গাল আর নাক নিমেষেই কেমন গোলাপী হয়ে উঠলো।বাবাও পিছু পিছু গেল।দেখলো জেনি খাটের ওপর পা তুলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ ছল ছল করছে।জোসেফ মেঝেতে তার সামনাসামনি বসলো।তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”জেনি মাই প্রিন্সেস! আমি জানি তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো কারণ আমি তোমার চাহিদা কখনোই পূরণ করতে পারিনা।মা! আমি আমার সর্বস্ব চেষ্টা করি, কিন্তু ঈশ্বর আমাকে তোমার চাহিদা পূরণ করার সামর্থ্য দেননি।
জেনি আগের মতই নিশ্চুপ হয়ে ছিল।জোসেফের মুখে বিষাদের রেখা।হটাৎ করেই সেখান থেকে এক মুঠো আনন্দের রশ্মি ফুটে উঠলো।জোসেফ বললো তবে এইবার আমি আমার প্রিন্সেসের একটা ইচ্ছে হয়তো পূরণ করতে পারবো, একটা চওড়া হাসি দিয়ে জোসেফ গাউনের প্যাকেটটা জেনির হাতে দিল,জেনি কিছুটা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।”প্যাকেটটা খুলে দেখো” খুব উৎসাহ নিয়ে জোসেফ জেনিকে বললো।জেনি খুব আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটা খুললো, খুলে ভেতরে থাকা গাউনটা দেখে তার যে মনে কি আবেগ কাজ করছে তা বুঝতেই পারলনা জোসেফ।
সে কি খুশি হলো?
নাকি হতাশ?
এসব ভাবতে ভাবতেই জেনি বলে উঠলো
–“উফফফ!! বাবা কি এনেছ এটা?
— কেন? তুমি অনেকদিন ধরে একটা গাউন চাইছিলে না? এতদিন সংসারের টানাপোড়নে সুযোগই হয়ে উঠেনি।আজ কিছু টাকা পেলাম তাই নিয়ে এলাম।
— কিন্তু আমি তো গাউন চেয়েছিলাম গতবছর।
— কি করবো বল? ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিলনা।
— শোনো বাবা।এটা পুরনো মডেল, আমার এটা এখন আর লাগবেনা।তোমার যদি একান্তই কিছু দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে বাজারে নতুন একটা স্কার্ট এসেছে মারমেইড স্কার্ট ঐটা কিনে দাও।
— ঠিকাছে তা নাহয় দেব।কিন্তু দাম কত পড়বে?
— বেশি না ছয়শত ডলার নেবে।
দাম শুনে জোসেফের বুকের মধ্যে ধপ করে উঠলো।সে ভাবতে লাগলো এত টাকা সে কোথায় পাবে।তার ছয় সপ্তাহের পুরো মাইনে জমালে তবেই একটা স্কার্ট কেনা সম্ভব।যেটা একেবারে দুঃসাধ্য ব্যাপার।এত টাকা আমি কোথায় পাবো মা?জোসেফ বিব্রত হয়ে বললো।
— জানিনা আমি।যদি নাই দিতে পারো তাহলে এসবেরও প্রয়োজন নেই।ফেরত দিয়ে এসো।
–জেনি তোমাকে যদি একটা অনুরোধ করি রাখবে?
— জানি কি বলবে।এটাও সামনের বছর দেবে তাইতো?
— না না! সামনের বছর না।তুমি যেহেতু চাইছো, আমি চেষ্টা করবো বড়দিনে তোমাকে ওরকম একটা স্কার্ট উপহার দিতে। বড়দিন আসতে আর মাত্র ছয়মাস বাকি।ততদিনে আমি একটু টাকা জমাতে পারবো।আর এই গাউন টাও তোমারই থাকলো, এটা আর ফেরত দিতে হবেনা।
জেনি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে শেষ পর্যন্ত মেনে নিল।তারপর দুজনে মিলে সেই সস্তা কেক কেটে মোটামুটিভাবে জন্মদিন উদযাপন করলো।জোসেফের হাসিমাখা মুখের আড়ালে কষ্টের পরিধিটা বোঝার ক্ষমতা জেনির ছিলনা।এরপর কয়রাত যে জোসেফ ঘুমোতে পারেনি তা নিজেও জানেনা।একদিকে পূর্বের ধার পরিশোধ, সংসারের খরচ আর অন্যদিকে একমাত্র মেয়ের ইচ্ছে পূরণ, কি করবে জোসেফ? জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম দিনগুলো পাড় করতে লাগলো সে।
(চলবে)
sidneynews24/ar.razu hawlader
Leave a Reply